উপস্থাপনা:

আজেকর বিশ্বে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। আর এই দেশের জনগোষ্ঠির প্রায় অর্ধেকের বেশিই তরুণ, যুবক। বিপুল সংখ্যক এই তরুণই মানবকল্যানে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।তরুণদের সচেতনতার দ্বারায় শিক্ষা ও সার্বিক স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চয়তার মাধ্যমে দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব।তরুণরাই পারে ভবিষ্যত বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে সচেতনতার মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখতে। তাদের শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমেই বাংলাদেশকে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত করে সুন্দর –সুস্থ স্বাভাবিক মানব সম্পদের দেশ হিসেবে পরিণত করা যায়।

থ্যালাসেমিয়াঃ
থ্যালাসেমিয়া একপ্রকার রক্তের রোগ যা সাধারণত বংশগত ভাবে হয়ে থাকে । এই রোগ শরীরে রক্তস্বল্পতার সৃষ্টি করে যা রক্তের মধ্যে ত্রুটিযুক্ত হিমোগ্লোবিনের জন্য হয়ে থাকে।থ্যালাসেমিয়া ধারনকারী মানুষ সাধারনত রক্তস্বল্পতা বা অক্সিজেনস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়াতে ভুগে থাকে। এর ফলে অবসাদ্গ্রস্থতা থেকে শুরু অঙ্গহানি পর্যন্ত হতে পারে।
থ্যালাসেমিয়া সাধারনত ২ ধরনের হয়ে থাকে। আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বেটা থ্যালাসেমিয়া। আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ বেটা থ্যালাসেমিয়ার তুলনায় কম হয়ে থাকে।বেটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি। এই রোগে আক্রান্ত শিশুকে সঠিক চিকিৎসা না করালে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ ও হতে পারে।

আলফা থ্যালাসেমিয়াঃ
প্রতিটি মানবদেহে চারটি জিন দ্বারা আলফা থ্যালাসেমিয়া শিকল গঠিত হয়। বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা ততোধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। যত বেশি জিন ত্রুটিপূর্ণ হবে শরীরে তত বেশি মারাত্মক সমস্যা দেখা দিবে।সাধারনত একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে কোন উপর্সগ বা লক্ষণ দেখা দিবে না কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার সন্তানের দেহে এই রোগ ছড়াতে পারে। দুইটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপর্সগ দেখা যেতে পারে। এই অবস্থাকে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা ট্রেইট (ALPHA THALASSEMIA MINOR OR TRAIT)। তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে উপসর্গ মারাত্মক আকার ধারণ করে।এই অবস্থাকে বলে হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ (HIMOGLOBIN H DIEASE)। আর যদি কার ও চারটি জিন ত্রুটিপূর্ণ অবস্থায় থাকে তবে তাকে আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (ALPHA THELASSEMIA MAJOR) বা হাইড্রপস ফেটালিস ( HYDROPS FETALIS) বলে। এর ফলে প্রসবের পরপর বা পূর্বেই ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়। তাই যতটা এই রোগ সম্পর্কে সকলকে অবহিত করতে হবে এবং সচেতন করতে হবে। সচেতনতার মাধ্যমেই এই রোগের ভয়াবহতা দূর করা সম্ভব।

বিটা থ্যালাসেমিয়ারঃ
মানবদেহে বিটা থ্যলাসেমিয়া শিকল গঠিত হয় দুইটি জিন দ্বারা । মা – বাবা থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা একাধিক জিন সমস্যাপূর্ণ হলে সাধারণত বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে একটি জিনে সমস্যা হলে হালকা উপসর্গ দেখা যায়।এই অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা ট্রেইট (BETE THALASSEMIA MINOR OR TRAIT) ।আবার যদি দুটো জিনেই সমস্যা হয় তবে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়। এই অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর ( BETE THALASSEMIA MAJOR) বা কুলিস এনিমিয়া( KOOLEY’S ANEMIA)। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ বিটা থ্যালাসেমিয়া জিন বহন করে।

থ্যালাসেমিয়া রোগের লক্ষণ বা উপসর্গঃ
শরীরে রক্তের লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল মাত্র তিন মাস। মানবদেহের অস্থিমজ্জায় অনবরত লোহিত কণা সৃষ্টি হয়। আর তিন মাস পূর্ণ হলেই প্লীহা লোহিত কণিকাকে রক্ত থেকে সরিয়ে দেয় । কিন্তু থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল অনেক কমে যায়। তাদের হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ার ফলে সময়ের পূর্বেই লোহিত কণিকা ভেঙ্গে যায় এবং অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয় না। তাই থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগির দেহে নিম্মোক্ত লক্ষ্ণ সমূহ দেখা যায়ঃ
# অবস্বাদ অনুভব,
# দূর্বলতা,
# শ্বাসকষ্ট ,
# অস্বস্তি ,
# মুখমন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ,
# ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস) ,
# গাঢ় রঙের পস্রাব হওয়া ,
# অস্বাভাবিক অস্থি ,
# মুখের হাড়ের বিকৃতি ,
# প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া ,
# পেট ফুলে যাওয়া ,
# শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস ।
উপরোক্ত লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখানো উচিত এবং সঠিক চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।

প্রতিরোধঃ
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দ্বারা থ্যালাসেমিয়া রোগ পরিপূর্ণ ভাবে নির্মূল সম্ভব না হলেও সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। সমাজে সচেতনতা বাড়াতে প্রচার মাধ্যমের ব্যাপক অংশগ্রহন প্রয়োজন।টেলিভিশন, পত্রিকা, রেড়িও , ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার,মেসেঞ্জারের মাধ্যমে সমন্বিত প্রচার করা আবশ্যক। এই রোগ নির্মূলের জন্য প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত জেনেটিক কাওন্সিল স্থাপন ও পরামর্শপ্রদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম । এই রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ও প্রয়োজন। এছাড়া নিম্ন লিখিত বিষয়ের প্রতি ও সচেতন থাকতে হবে। যেমনঃ
# বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র ও পাত্রীর রক্ত পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত।নিকিটাত্মীয়ের বিবাহের ক্ষেত্রে এ রোগের সম্ভবনা বেশি থাকে তাই সাবধানতা ও সচেতনতা অবলম্বন করা একান্ত আবশ্যক।
# সচেতনতার পাশাপাশি গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া আছে কিনা ত পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
# নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত।
# বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করা।
# হেপাটাইটিস ভি ভাইরাসের টিকা নেওয়া উচিত ।
# শিশুদের ক্ষেত্রে তিন মাস পরপর উচ্চতা, ওজন, লিভার ফাংশন পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
# শিশুর প্রতি বছর বুদ্ধি ও বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা ।

আমাদের দেশে এই রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ ই সহজ। তাই সমন্বিত স্বাস্থ্য কর্মসূচী ও সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন।সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যাক্তিগত সচেতনতার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ করা যায় যা তরুণদের দ্বারায় সম্ভব।

চিকিৎসাঃ
বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা করা হয়। সাধারণত মাইনর থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। অপর দিকে মেজর থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে নিয়মিত রক্ত গ্রহণ করতে হয়। বারবার রক্ত নেওয়ার ফলে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে লৌহ জমতে পারে ও যকৃত বিকল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এরকম ক্ষেত্রে জটিলতা এড়াতে আইরন চিলেশন থেরাপীর সাহায্যে অতিরিক্ত লৌহ বের করা যায়। এছাড়া বোন ম্যারো বা অস্থি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেও রোগ মুক্ত থাকা যায়।

উপসংহারঃ
থ্যালাসেমিয়া একটি রক্তের রোগ হলেও সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ নয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির তাই যথাসম্ভব সাবধানতা ও সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত।রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সঠিক চিকিৎসার দ্বারা আরোগ্য লাভ ও সম্ভব। আর যেহেতু এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগ এবং চিকিৎসা ও বেশ ব্যায়বহুল তাই এই রোগ থেকে মুক্ত থাকার সর্বোত্তম পন্থা হলো সার্বিক সচেতনতা বজায় রাখা।এই রোগ নির্মূলের একটি অন্যতম হাতিয়ার হলো সমাজের সকল স্তরের জনগণের মাঝে প্রচার প্রসারের মাধ্যমে সচেতন করা এবং প্রতিরোধ করা । আর এ লক্ষ্যে তরুণদের এগিয়ে আসা এবং কাজ করা একটি লক্ষনীয় উদাহরণ।