বাংলা ছবি আমাদের একটা অনেক আবেগের জায়গা, যাহা বাস্তবের উপরে পর্দায় ধরা দিত, একটা সময় মানুষ স্বপ্ন দেখত সিনেমা হলের পর্দায় , চলিত কথা বাংলা চলচ্চিত্রর নাম হয়ে গেল ছবি । এই চল যাবি বাংলা ছবি দেখে আসি, কিংবা কই গিয়েছিলি ছবি দেখতে। আজকে আমরা বাংলা ছবি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব ।
বাংলা ছবি র ইতিহাস ও হীরালাল সেন ।
বাংলা চলচ্চিত্র বা বাংলা সিনেমা বা বাংলা ছবি র শুরুটা হিরালাল সেন এর হাত ধরে , ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দের কলকাতায় বাঙালিদের মধ্যে প্রথম বায়োস্কোপ কোম্পানি গঠন করেন মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরী গ্রামের হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭)। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির নাম দ্য রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি। তিনিই ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর তোলা খণ্ডচিত্র (নাটক থেকে) সীতারাম, আলীবাবা, দোললীলা, ভ্রমর, হরিরাজ বুদ্ধ ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতার স্টার থিয়েটার ও ক্ল্যাসিক থিয়েটারে প্রদর্শিত হয়। তিনি প্রামাণ্য চিত্র, বিজ্ঞাপন চিত্র এবং সংবাদচিত্রও নির্মাণ করেন। ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞাপনে ফিল্ম ব্যবহার করায় তিনিই প্রথম ছিলেন ।
ঢাকায় চলচ্চিত্র
সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশ সূত্রে ঢাকায় প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনের প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়। ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল বায়োস্কোপ দেখানো হয় ঢাকার সদরঘাটস্থ পাটুয়াটুলীর ক্রাউন থিয়েটারে (এখন অবলুপ্ত)। কলকাতা থেকে আগত ব্রেডফোর্ড বায়োস্কোপ কোম্পানি এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রদর্শিত ছোট ছোট ছবির মধ্যে ছিল মহারানী ভিক্টোরিয়ার জুবিলি মিছিল, গ্রিস ও তুরস্কের যুদ্ধ, তিনশত ফুট উঁচু থেকে প্রিন্সেস ডায়ানার লাফ, রুশ সম্রাট জারের অভিষেক, পাগলা নাপিতের ক্ষৌর কর্ম, সিংহ ও মাহুতের খেলা, ইংল্যান্ডের তুষারপাতে ক্রীড়া, ফ্রান্সের রাস্তাঘাট ও পাতাল রেলপথ ইত্যাদি দৃশ্য। টিকেটের হার ছিল আট আনা থেকে তিন টাকা। পরে বাংলাদেশের আরও অনেক স্থানে যেমন মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামে, ভোলার এসডিওর বাংলোতে, ঢাকার জগন্নাথ কলেজ মিলনায়তনে, ভাওয়াল এস্টেটএর রাজপ্রাসাদে, ফরিদপুরের পালং-এ, ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক ও আহসান মঞ্জিলএ বায়োস্কোপ দেখানো হয়। ঢাকায় নিয়মিতভাবে বায়োস্কোপ প্রদর্শন শুরু হয় ১৯১৩-১৪ সালের দিকে আরমানিটোলার পাটের গুদামে। পরে এখানে স্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ স্থাপিত হয় ‘পিকচার হাউজ’ (পরবর্তীকালে শাবিস্তান) নামে। এটিই বাংলাদেশের প্রথম সিনেমা হল। ১৯৯৪ সালেও দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার।
১৯২৭-২৮ সালের দিকে ঢাকার নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তারা সুকুমারী নামে চার রিলের একটি নির্বাক ছবি বানান। ছবিটি পরিচালনা করেন বিশিষ্ট নাট্যকর্মী ও জগন্নাথ কলেজের শরীরচর্চার প্রশিক্ষক অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত। ছবির নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন খাজা নসরুল্লাহ ও নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন সৈয়দ আবদুস সোবহান। তখন মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করানো অসম্ভব কাজ ছিল । সুকুমারীর সাফল্যের পর নওয়াব পরিবারের তরুণরা ঢাকা ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন
চলচ্চিত্রে কাজী নজরুল ইসলাম ।
উনার আমলে গান বাজনা শিল্প সাহিত্য যেখানে আর কাজী নজরুল ইসলাম থাকবেন না তা হয় নাকি? অভিভক্ত বাংলা ছবি / চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ব্যতিক্রর্মী সংযোজন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। ১৯৩১ সালে তিনি চলচ্চিত্রে জড়িত হন কলকাতার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ম্যাডান থিয়েটারসের সুরকার হিসেবে। পরে তিনি চিত্র পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, কাহিনীকার, সংগঠক হিসেবে তাঁর অসামান্য মুন্সিয়ানার ছোয়া রাখেন। ১৯৩৪ সালে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ দে-র সঙ্গে যৌথভাবে ধ্রুব চিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি শেরে বাংলার নামে বি.টি পিকচার্স গঠন করেন ।
বাংলা ছবি / চলচ্চিত্র ও পুর্ব পাকিস্তান
১৯৪৭ সালে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের নতুন প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি করে। রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে নতুন করে শুরু হয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র প্রযোজনা, পরিবেশনা এবং স্টুডিও নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কারন ততদিনে ইস্টম্যান কোডাক সিনেমা শিল্পের যথেস্ট উন্নত যন্ত্রপাতি বের করেছে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে বেতার-ব্যক্তিত্ব নাজীর আহমদকে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি কলকাতার কুশলীদের সহায়তায় ইন আওয়ার মিডস্ট নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এটিই পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের প্রথম তথ্যচিত্র।
সরকারি উদ্যোগে জনসংযোগ বিভাগের অধীনে প্রচারচিত্র নির্মাণের জন্য চলচ্চিত্র ইউনিট (১৯৫৩) গঠিত হয়। এজন্য ঢাকার তেজগাঁও স্টুডিও এবং ল্যাবরেটরি স্থাপনের চেষ্টা চলে। এ ইউনিট থেকে নাজীর আহমদের পরিচালনায় নির্মিত হয় প্রামাণ্য চিত্র সালামত (১৯৫৪)। ১৯৫৫ সালে জুন মাসে তেজগাঁওয়ে সরকারি ফিল্ম স্টুডিও চালু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চিত্র খ ও মুখোশ , আব্দুল জববার খানের পরিচালনায় মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ।
১৯৫৭ সালের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তান আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান ফিল্ম কর্পোরেশন বিল উত্থাপন করেন যা FDC এর ভিত্তি ।দশকে এফডিসি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এখানকার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ১৯৫৯ সালে থেকে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। ৬০ এর দশকে আবির্ভাব ঘটে বেশ কিছু লিজেন্ডারি অভিনেতার যার মধ্যে রহমান, সুমিতা দেবি, খান আতাউর রহমান, আজিম, রাজ্জাক, শাবানা, কবরী, বেবি জামানসহ আরো অনেকে
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ চলচ্চিত্র :
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রেরর সবচেয়ে বেশি প্রচার এবং প্রসার লাভ করেছে। সেটা ব্যবসায়িক এবং সমালোচক দুই দৃষ্টিতেই। ১৯৭১ সালের বিজয়ের মাসেই EPFDC নাম পরিবর্তিত হয়ে “বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলভম্যান্ট কর্পোরেশন” (BFDC) করা হয়। এসময়ে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বেশ কিছু উল্ল্যেখযোগ্য চলচ্চিত্র নির্মান হয় , এই সময়েই পরিচালনায় আসেন আলমগীর কবির, আব্দুল্লাহ আল মামুন, নারায়ন ঘোষ, ওপার বাংলার হৃিত্তিক ঘটক, কাজী হায়াত, নেয়ামত আলী সহ আরো বিখ্যাত পরিচালকরা। ধীরে বহ মেঘনা, তিতাস একটি নদীর নাম, আলোর মিছিল, সূর্যদীঘল বাড়ি, লালন, পিতা সহ অসংখ্যা কালজয়ী চলচ্চিত্র এসময়ে নির্মিত হয়।
বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী সময় :
১৯৮০ থেকে ১৯৯৯ এই সময়টা বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ হিসেবে বিবেচিত হয়। এসময়ে সময়ে বাংলা চলচ্চিত্র দেশের গন্ডি পেরিয়ে বাইরেও একটা অবস্থান সৃস্টি করে। এসময়ে একই সাথে অনেকগুলো তারকা শীর্ষ পর্যায়ে পৌছেছিলো। এদের মধ্যে রাজ্জাক, কবরী, শাবানা, ওয়াসিম, জাফর ইকবাল, জসিম, রোজিনা, ইলিয়াস কাঞ্চন, দিতি, সালমান শাহ, মৌসুমি, নাইম , শাবনাজ, শাবনুর, অমর সানী, দিলদার অন্যতম। আবির্ভাব হয় বিখ্যাত উপ্যানাসিক হুমায়ুন আহমেদ, তারেক মাসুদ,তানভীর মোকাম্মেম, মোরশেদুল ইসলাম, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সহ অনেক প্রতিথযশা ব্যক্তির। ইনারা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমাদের সামনে ভিন্নধর্মী ভাবনা তুলে ধরেন ।
এসময়েই নির্মিত হয় কালজয়ী বাংলা ছবি/ চলচ্চিত্র হারানো সুর, দহন, মান সম্মান, ভাত দে, ছুটির ঘন্টা, দেবদাস, রাজলক্ষী-শ্রীকান্ত, দিপু নাম্বার ২ সহ অনেক উল্ল্যেখযোগ্য চলচ্চিত্র। সরকারিভাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান শুরু হয় ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র থেকে।
বাংলা চলচ্চিত্রের বেহাল দশা এবং বর্তমান :
২০০০ সালের আসে পাশের দিকে বাংলা চলচ্চিত্রেরর দর্শক সংখ্যা কমতে থাকে। প্রধান কিছু কারন ছিলো দূর্বল নির্মানশৈলি, নিম্নআয়ের অডিয়েন্স টার্গেট করে সিনেমা নির্মান, বিদেশি সিনেমার কপি বিশেষ করে ভারতীয় চলচ্চিত্রের। নতুন শতকের শুরুতে অশ্লীলতা মহামারী আকার ধারন করে। ১২০০ সিনেমা হল থেকে ৩০০ তে নির্গমন হয়। মধ্যবিত্তরা পুরোপুরি হল বিমুখ হওয়ায় বাংলা চলচ্চিত্রে বড় ধস নামে। বন্ধ হয়ে যায় বড় বড় প্রযোজনা প্রতিষ্টানগুলো। দু একজন নায়কের একনায়কতন্ত্র সহ পরিচালকদের পুরনো ধ্যান ধারনার কারনে ধুকতে বসে বাংলা চলচ্চিত্র।
প্রবাদ প্রতিম নায়ক রাজ রাজ্জাক বলেছিলেন , ‘আমাদের বাংলা ছবি / চলচ্চিত্র কি ছিল আর কোথায় যাচ্ছে? বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্র উঠছে আর নামছে। এই ওঠা নামাটা হচ্ছে প্রক্ষাগৃহে ছবি প্রদর্শনের জন্য উঠছে এবং দু’দিন পরই নেমে যাচ্ছে।’ অনেকটা হতাশা নিয়েই রাজ্জাক বলেন, ‘এখন আর এফডিসি কেন্দ্রিক ছবি হচ্ছেনা বলেই সবাই বাইরের দেশে গিয়ে ছবির শুটিং করছে। তাছাড়া আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেকে টেলিফিল্মকেই জোর করে চলচ্চিত্র বানিয়ে দিচ্ছেন। যেটা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে ধোঁকা হিসেবে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে তারা ছবি দেখা ছাড়ছে।’
শুধুমাত্র সিনেমা হলের পরিবেশ না থাকায়, সিনেমাগুলো হারাচ্ছে দর্শক এবং সাথে সিনেমায় বিনিয়োগকৃত অর্থ। সিনেমা হলের পরিবেশ এর কারণে মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলাদেশের পুরো সিনেমা শিল্প। মাল্টিপ্লেক্স গুলির রম রমা ব্যবসা তাঁর প্রমান ।
এখন ঈদ আসলে বাংলা ছবি র বাজার কিছুটা রমরমা থাকে আর বাকিটা সময় আবার ধুকতে থাকে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প ।