কবিতা কি?

সাহিত্যের সুর কবিতা, আমার মতে ছন্দোবদ্ধ ভাষায় যে সকল পদ্য লেখা হয় তাকে কবিতা বলে। কেউ কেউ বলেন,কবিত হচ্ছে শ্রুতিনান্দনিক শব্দের সমন্বয়ে তালে ও ছন্দে বিন্যস্ত, আবেগঘন,অর্থ প্রকাশ কথন বা লেখন।

*কোলরেজ বলেন,Best word in the best order.

* ওয়াপর্স ওয়ার্থ বলেন,Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings.অর্থাৎ, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এই পাওয়ারফুল ফিলিংসটা খুজে পাওয়া যায় না, কেমন পানসা লাগে কবিতা।

*সহজ ভাষায় বলা যায়, মানব মনের ভাবনা-কল্পনা যখন অনুভূতি রঞ্জিত যথাবিহিত শব্দসম্ভারে বাস্তব সুষমামণ্ডিত চিত্রাত্নক ও ছন্দোময় রূপ লাভ করাকেই কবিতা বলে।

*কবিতার মূল নির্দেশ করতে রবী ঠাকুর বলেছেন–
‘অন্ত হ’ তে আহরি বাচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতির রস ধারা করি সিঞ্চন
সংসার -ধুলিজলে।

*কবিতা নিরাভরণা নয়।
নারী যেমন আকার -সাকারে, ইঙ্গিতে, সাজসজ্জায়,রং-চঙ্গে,বিলাস-প্রসাধনে নিজেকে আকর্ষনীয় করে তোলে(!) কবিতা ও তেমনি শব্দে, মায়ায় , মর্মে ছন্দে উপমায় চিত্রে ও অনুভূতির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে।

*এবার বলি আসল কথা,নীতিপ্রচার শিক্ষাদান,বা রাজনীতি বা সমাজনীতি প্রচার করা কাব্যের উদ্দেশ্য নয়। ইহা শুধু মনের ভাব প্রকাশ করা।

ছন্দ কী?

ছন্দ হচ্ছে কবিতার প্রাণ।বিনা ডিমে কখনো যেমন ওমলেট হয় না,তেমনি কাব্যগুণ না থাকলেও কবিতা হয় না।ছন্দ জিনিসটা আসলে কি? ওটা আর কিছুনা কবিতার শরীরে দোলা লাগাবার কায়দা,এতে নানান দোলনায় কবিতাকে দোলানো যায়।
দৃষ্টান্তমূলক—-
সকল বেলা কাটিয়া গেল
বিকাল নাহি যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই কথাগুলিকে খুবই মর্মগ্রাহী করে বলতে পারতেন। কিন্তু ছন্দের মাধ্যমে এই ভাবে না বললে মোক্ষম ভাবে জাগিয়ে তুলতে পারতেন না।

* কাব্যের রসঘন ও শ্রুতিমধুর বাক্যে সুশৃঙ্খল ধ্বনিবিন্যাসের ফলে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় তাকে ছন্দ বলে।
(জীবেন্দ্র রায়)

বিভিন্ন প্রকার ছন্দ সম্পর্কে জানার পূর্বে ছন্দের কিছু উপকরণ সম্পর্কে জেনে নেয়া আবশ্যক।আর ছন্দ পড়ার আগে আরেকটি জিনিস আবশ্যক।ছন্দ সর্বদা উচ্চারণের সাথে সম্পর্কিত,বানানের সঙ্গে নয়,আর ছন্দের ব্যাপারে ধ্বনিটাই প্রধান কথা,অক্ষর টা নয়। 
* অক্ষর:স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোঁক শব্দের যে অংশটুকু উচ্চারিত হয়,তাকে অক্ষর বা দল বলে।অক্ষর অনেকটাই ইংরেজি সিলেবল এর মত।
যেমন :চিরজীবী,
চি, রো,জী,বি-৪,
কুজ্ঞ,
কুন,জোন-২,অক্ষর।
*মাত্রা:আমরা আসলেই এটাই বুঝি যার দ্বারা কোনো কিছুর পরিমাপ করা যায়, তাকেই মাত্রা বলি।

কিন্তু আপাদত ইহাই জানি,কবিতার এক একটি পংক্তির মধ্যে যে ধ্বনিপ্রবাহ থাকে,এবং তাকে উচ্চারণ করার জন্য মোট যে সময় লাগে,সেই উচ্চারণকালের ক্ষুদ্রতম এক একটা অংশই হল মাত্রা।যেমন:-
ষোলো কলায় চাঁদ পূর্ণ হয়।

*সিলেবল:কোনও কিছু উচ্চারণ করতে গিয়ে ণূন্যতম চেষ্টায় যেটুকু আমরা বলতে পারি, তাই হচ্ছে একটি সিলেবল।
যেমন:কবিঙ্কণ-ক+বি+কং+কন।
শব্দটি চাঁরটি সিলেবলে এর সমবায়ে গঠিত।

*যতি বা ছন্দ-যতি:কোন বাক্য পড়ার সময় শ্বাস গ্রহণের সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে অন্তর যে উচ্চারণ বিরতি নেয়া হয় তাকে ছন্দ বলে।

*যতি মূলত ২ প্রকার :হ্রস্ব যতি ও দীর্ঘ যতি।অল্পক্ষণ বিরতির জন্য সাধারণ বাক্য বা পদের মাঝখানে হ্রস্ব যতি দেয়া হয়, আর বেশিক্ষণ বিরতির জন্য সাধারণ বাক্য বা পদের শেষের দীর্ঘ যতি ব্যবহৃত হয়।

*পর্ব:বাক্য বা পদের এক হ্রস্ব যতি হতে
আরেক হ্রস্ব যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলা হয়।

*শ্বাসঘাত :প্রায়ই বাংলা কবিতা পাঠ করার সময় পর্বের প্রথম অক্ষেরের উপর একটা আলাদা জোর দিয়ে পড়তে হয়,এই অতিরিক্ত জোর দিয়ে পাঠ করা বা আবৃত্তি করাকে বলা হয় শ্বাসঘাত বা প্রসর।

*পদ ও চরণ:দীর্ঘ যতি ছাড়াও এই যতির মধ্যবর্তী বিরতির জন্য মধ্যযতি ব্যবহৃত হয়।
দুই দীর্ঘ যতির মধ্যবর্তী অংশকে চরণ বলে,আর মধ্য যতি দ্বারা চরণকে বিভক্ত করা হলে। সেই অংশগুলোকে বলা হয় পদ।

*স্তবক : অনেকগুলো চরণ নিয়ে একটি স্তবক গঠিত হয়,সাধারণত,একটি স্ববকে ভাব প্রকাশিত হয়।

*মিল:একাধিক পদ,পর্ব বা চরণের শেষে একটি রকম ধ্বনি ব্যবহারকে মিল বলা হয়।

*স্বরবৃত্ত ছন্দ:ছড়ায় বহুল ব্যবহৃত হয় বলে, এই ছন্দকে ছড়ার ছন্দও বলা হয়।

★মূল পর্ব সবসময় ৪ মাত্রা হয়।

★প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষরে শ্বাসঘাত পড়ে।

★সব অক্ষর ১ মাত্রা গুনতে হয়।

★দ্রুত লয় থাকে,মানে কবিতা আবৃত্তির সময়ে দ্রুত পড়তে হয়।

★উদাহরণ:বাঁশ বাগানের। মাথার উপর উপর।চাঁদ উঠেছে।ওই।৪+৪+৪+১.
★মাগো আমার।শোলোক বলা।কাজলা দিদি। কই।৪+৪+৪+১.

* মাত্রাবৃত্ত ছন্দ:

★ মূল পর্ব ৪,৫,৬ বা ৭মাত্রার হয়।

★অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা গুণতে হয়,আর অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে (য় থাকলে ও) ২ মাত্রা গুণতে হয়;য় থাকলে, যেমন –হয়, কয়;য়– কে বলা যায় Semi-vowel.পুরো
স্বরধ্বনি নয়,তাই এটি অক্ষরের শেষে থাকলে।

★ কবিতা আবৃত্তির গতি স্বরবৃত্ত ছন্দের চেয়ে তধীর,কিন্তু অক্ষরবৃত্তের চেয়ে দ্রুত।
উদাহরণ:এইখানে তোর।দাদির কবর।ডালিম গাছের। তলে।৬+৬+৬+২.

তিরিশ বছর। ভিজিয়ে রেখেছি।দুই নয়নের। জলে।৬+৬+৬+২.

*অক্ষরবৃত্ত ছন্দ:

★মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়।

★অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা গুণতে হয়।

★অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে,এমন অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা হয়;
শব্দের শেষে থাকলো ১ মাত্রা হয়।

★কোন শব্দ এক অক্ষরের হলে,এবং সেই অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে অক্ষরটির মাত্রা ২ হয়।

★কবিতা আবৃত্তির গতি ধীর হয়।

উদাহরণ—

★কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি।১০.

★দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি।১০.

*অক্ষরবৃত্ত ছন্দের রূপ বা প্রকার:অক্ষরবৃত্ত ছন্দের অনেকগুলো রূপ বা প্রকার আছে।

★ পয়ার, মহাপয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী, দিগক্ষরা, একা বলা,সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ।এদের মধ্যে সব’চে গুরুত্বপূর্ণ হল সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ।নিম্নে আলোকপাত করা হল–

 

সনেট:

★বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।  বাংলায় উল্লেগযোগ্য সনেট রচয়িতা –মাইকেল মধুসূদন দত্ত,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,জীবনানন্দ দাশ,প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার,ফররুখ আহমদ,কামিনী রায়। সনেট ১৪, ১৮,২২,২৬,৩০ মাত্রার হয়। সনেটে দুই স্তবকে ১৪ টি চরণ থাকে।

★সাধারণত দুই স্তবকে যথাক্রমে ৮ টি ও ৬ টি চরণ থাকে।( চরণ বিন্যাসে ব্যতিক্রম থাকতে পারে)

★প্রথম ৮ টি চরণের স্কবককে অষ্টক ও ৬ টি চরণের স্তবককে ষষ্টক বলে।

★নির্দিষ্ট নিয়মে অন্ত্যমিল থাকে।

★সনেটের ভাষা মার্জিত এবং ভাব গভীর ও গম্ভীর হতে হয়।

★ সনেট মূলত ৩ প্রকার: পেত্রার্কীয় সনেট, ২,শেক্সপীয়রীয় সনেট,  ৩,ফরাসি সনেট।

*গদ্যছন্দ :

★ এই ছন্দে বাংলায় প্রথম যারা কবিতা লিখেছিলেন তাদের অন্যতম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

★মূলত ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী শিল্পমুক্তির আন্দোলনের ফসল হিসেবে এর জন্ম।

★গদ্যছন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,গদ্যের মধ্যে যখন পদ্যের রং ধরানো হয় তখন গদ্য কবিতার জন্ম হয়।

★পর্বগুলো নানা মাত্রার হয়,সাধারণত পর্ব দৈর্ঘ্যে কোন ধরনের সমতা বা মিল থাকে না।

★গদ্য কবিতা গদ্যে লেখা হলেও তা পড়ার সময় এক ধরনের ছন্দ বা সুরের আভাস পাওয়া যায়।